আয়না গল্প জসীম উদ্দীন
আয়না গল্প পল্লী কবি জসীম উদ্দীন এর এক অনবদ্য ছোট গল্প । সহজ-সরল গ্রামীণ মানুষের জীবনাচার নিয়ে তৈরি আয়না গল্প। আসুন আমরা আয়না গল্পটি পড়ি :

আয়না গল্প জসীম উদ্দীন
এক চাষি ক্ষেতে ধান কাটিতে-কাটিতে একখানা আয়না কুড়াইয়া পাইল। তখন এদেশে আয়নার চলন হয় নাই। কাহারও বাড়িতে একখানা আয়না কেহ দেখে নাই। এক কাবুলিওয়ালার ঝুলি হইতে কী করিয়া আয়নাখানা মাঠের মাঝে পড়িয়া গিয়াছিল। আয়নাখানা পাইয়া চাষি হাতে লইল। হঠাৎ তাহার উপরে নজর দিতেই দেখে, আয়নার ভিতর মানুষ! আহা হা, এযে তাহার বাপজানের চেহারা!
বহুদিন তার বাপ মারা গিয়াছে। আজ বড় হইয়া চাষির নিজের চেহারাই তার বাপের মতো হইয়াছে। সব ছেলেই বড় হইয়া কতকটা বাপের মতো চেহারা পায়। তাই আয়নায় তাহার নিজের চেহারা দেখিয়াই চাষি ভাবিল, সে তাহার বাবাকে দেখিতেছে। তখন আয়নাখানাকে কপালে তুলিয়া সে সালাম করিল। মুখে লইয়া চুমো দিল। “আহা বাপজান! তুমি আসমান হইতে নামিয়া আসিয়া আমার ধানক্ষেতের মধ্যে লুকাইয়া আছ! বাজান বাজান! ও বাজান!”
চাষি এ ভাবে কথা কয় আর আয়নার দিকে চায়। আয়নার ভিতরে তাহার বাপজান কতই ভঙ্গি করিয়া চায়।
চাষি বলে, “বাজান! তুমি তো মরিয়া গেলে। তোমার ক্ষেত ভরিয়া আমি সোনাদিঘা ধান বুনিয়াছি, শাইল ধান বুনিয়াছি। দেখ-দেখ বাজান! কেমন তারা রোদে ঝলমল করিতেছে। তোমার মরার পর বাড়িতে মাত্র একখানা ঘর ছিল। আমি তিনখানা ঘর তৈরি করিয়াছি। বাজান! আমার সোনার বাজান! আমার মানিক বাজান!”
সেদিন চাষি আর কোনো কাজই করিল না। আয়নাখানা হাতে লইয়া তার সবগুলি ক্ষেতে ঘুরিয়া বেড়াইল। সাঁঝ হইলে বাড়ি আসিয়া আয়নাখানাকে কোথায় রাখে। সে গরিব মানুষ। তাহার বাড়িতে তো কোনো বাক্স নাই! সে পানির কলসির ভিতর আয়নাখানাকে লুকাইয়া রাখিল।
যাকাত শব্দের অর্থ কি। যাকাতের খাত কয়টি। যাকাতের নিসাব কি
পরদিন চাষি এ কাজ করে, ও কাজ করে, দৌড়াইয়া বাড়ি আসে। এখানে যায়, সেখানে যায়, আর দৌড়াইয়া বাড়ি আসে। পানির কলসির ভিতর হইতে সেই আয়নাখানা বাহির করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে, আর কত রকমের কথা বলে! “বাজান! আমার বাজান! তোমাকে একলা রাখিয়া আমি এ-কাজে যাই ও-কাজে যাই, তুমি রাগ করিও না। দেখ বাজান! যদি আমি ভালোমতো কাজকাম না করি তবে আমরা খাইব কী?”
চাষির বউ ভাবে, “দেখরে। এতদিন আমার সোয়ামি আমার সাথে কত কথা বলিত, কত হাসি-তামাশা করিয়া এটা-ওটা চাহিত, কিন্তু আজ কয়দিন আমার সাথে একটাও কথা বলে না। পানির কলসি হইতে কী যেন বাহির করিয়া দেখে, আর আবোল-তাবোল বকে, ইহার কারণ কী?”
সেদিন চাষি ক্ষেত-খামারের কাজে মাঠে গিয়াছে। চাষির বউ গোপনে গোপনে পানির কলসি হইতে সেই আয়নাখানা বাহির করিয়া তাহার দিকে চাহিয়া রাগে আগুন হইয়া উঠিল। আয়নার উপর তার নিজেরই ছায়া পড়িয়াছিল; কিন্তু সে তো কোনোদিন আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নাই। সে মনে করিল, তার সোয়ামি আর একটি মেয়েকে বিবাহ করিয়া আনিয়া এই পানির কলসির ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে। সেইজন্য আজ কয়দিন তার স্বামী তার সাথে কোনো কথা বলিতেছে না। যখনই অবসর পায় ওই মেয়েছেলের সাথে কথা বলে। “আসুক আগে মিনসে বাড়ি। আজ দেখাইব এর মজা!” একটি ঝাঁটা হাতে লইয়া বউ রাগে ফুলিতে লাগিল; আর যে-যে কড়া কথা সোয়ামিকে শুনাইবে, মনে-মনে আওড়াইয়া তাহাতে শান দিতে লাগিল ।
“আসুক আগে মিনসে বাড়ি। আজ দেখাইব এর মজা!” একটি ঝাঁটা হাতে লইয়া বউ রাগে ফুলিতে লাগিল; আর যে-যে কড়া কথা সোয়ামিকে শুনাইবে, মনে-মনে আওড়াইয়া তাহাতে শান দিতে লাগিল।
SAARC সার্কভূক্ত দেশগুলোর নাম রাজধানী মুদ্রা
দুপুরবেলা মাঠের কাজে হয়রান হইয়া, রোদে ঘামিয়া, চাষি যখন ঘরে ফিরিল, চাষির বউ ঝাঁটা হাতে লইয়া তাড়িয়া আসিল; “ওরে গোলাম, তোর এই কাজ? একটা কা’কে বিবাহ করিয়া আনিয়াছিস?” এই বলিয়া আয়নাখানা চাষির সামনে ছুড়িয়া মারিল।
“কর কী? ও যে আমার বাজান!” অতি আদরের সাথে সে আয়নাখানা কুড়াইয়া লইল।
“দেখাই আগে তোর বাজান!” এই বলিয়া ঝটকা দিয়া আয়নাখানা টানিয়া লইয়া বলিল, “দেখ তো মিনসে ! এর ভিতর কোন মেয়েলোক বসিয়া আছে? এ ভোর নতুন বউ কিনা?”
চাষি বলে, “তুমি কি পাগল হইলে? এ যে আমার বাজান!”
“ওরে গোলাম! ওরে নফর। তবু বলিস তোর বাজান! তোর বাজানের কি গলায় হাসলি, নাকে নথ আর কপালে টিপ আছে নাকি?” বউ আরও জোরে চিৎকার করিয়া উঠিল ।
ও বাড়ির বড়বউ বেড়াইতে আসিয়াছিল। মাথায় আধ ঘোমটা দিয়া বলিল, “কিলো, তোদের বাড়ি এত ঝগড়া কিসের? তোদের ত কত মিল। একদিনও কোনো কথা কাটাকাটি শুনি নাই।”
চাষির বউ আগাইয়া আসিয়া বলিল- “দেখ বুবুজান! আমাদের মিনসে আর একটি বউ বিবাহ করিয়া আনিয়া পানির কলসির ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছিল। ওই সতিনের মেয়ে সতিনকে আমি পা দিয়া পিষিয়া ফেলিব না? দেখ-দেখ, বুবুজান! এই আয়নার ভিতর কে?”
ও বাড়ির বড়বউ আসিয়া সেই আয়নার উপরে মুখ দিল! তখন দেখা গেল আয়নার ভিতরে দুইজনের মুখ। ও বাড়ির বড়বউ বলিল, “এ তো তোর চেহারা। আর একজন কার চেহারাও যেন দেখিতে পাইতেছি।”
চাষি বলিল, “কী বলেন বুবুজান, এর ভিতর আমার বাপজানের চেহারা।”
এই বলিয়া চাষি আসিয়া আয়নার উপরে মুখ দিল। তখন তিনজনের চেহারাই দেখা গেল। তাহাদের কলরব শুনিয়া ও বাড়ির ছোট-বউ, সে বাড়ির মেজো বউ আসিল, আরফানের মা, রহমানের বোন, আনোয়ারার নানী আসিল। যে আয়নার উপরে মুখ দেয়, তাহারি চেহারা আয়নায় দেখা যায়- এ তো বড় তেলেছমাতির কথা!
শোন, শোন, এই কথা এ-গাঁয়ে সে-গাঁয়ে রটিয়া গেল। এ-দেশ হইতে ও দেশ হইতে লোক ছুটিয়া আসিল সেই জাদুর তেলেছমাতি দেখিতে। তারপর ধীরে-ধীরে লোকে বুঝিতে পারিল, সেটা আয়না।



