গম চাষ পদ্ধতি । সার প্রয়োগ ও অন্যান্য পরিচর্যা : দানা ফসল শর্করার প্রধান উৎস । এ কারণে পৃথিবীর সকল দেশে খাদ্যশস্য হিসেবে দানা ফসল চাষ করা হয় । বিশ্বের অনেক দেশে গম প্রধান খাদ্যশস্য। বাংলাদেশে ধানের পরে খাদ্যশস্য হিসেবে গমের অবস্থান দ্বিতীয় ।
বর্তমানে দেশের প্রায় সব জেলাতেই গমের চাষ করা হয় । তবে দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, জামালপুর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায় বেশি চাষ হয় । বাংলাদেশে গমের অনেক উচ্চফলনশীল অনুমোদিত জাত রয়েছে । তন্মধ্যে কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রাণী, প্রতিভা, সৌরভ, গৌরব, শতাব্দী, প্রদীপ, বিজয় ইত্যাদি জাত জনপ্রিয় ।

গম চাষ পদ্ধতি । সার প্রয়োগ ও অন্যান্য পরিচর্যা
গম চাষের সময় : গম চাষের উপযুক্ত সময় কখন
গম শীতকালীন ফসল । বাংলাদেশে শীতকাল স্বল্পস্থায়ী । এ কারণে গমের ভালো ফলন পেতে হলে সঠিক সময়ে গম বীজ বপন করা উচিত। আমাদের দেশে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত গম চাষের সময় । উঁচু ও মাঝারি দোঁআশ মাটিতে গম ভালো জন্মে । তবে লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয় । যেসব এলাকায় ধান কাটতে ও জমি তৈরি করতে দেরি হয় সেসব এলাকায় কাঞ্চন, আকবর, প্রতিভা, গৌরব চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায় ।
বীজের হার : বীজ গজানোর হার শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি হলে ভালো । এক হেক্টর জমিতে ১২০ কেজি গম বীজ বপন করতে হয় । বপনের আগে বীজ শোধন করে নিলে বীজবাহিত অনেক রোগ প্রতিরোধ করা যায়। প্রতি কেজি বীজ ৩ গ্রাম প্রভেক্স ২০০-এর সাথে ভালো করে মিশিয়ে বীজ শোধন করা যায় ।
বপন পদ্ধতি : জমিতে জো এলে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করতে হবে। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে সেচ দেওয়ার পর জো এলে চাষ দিতে হবে । সারিতে বা ছিটিয়ে গম বীজ বপন করা যায় । ছিটিয়ে বপন করলে শেষ চাষের সময় সার ও বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হয় । সারিতে বপনের ক্ষেত্রে জমি তৈরির পর ছোট হাত লাঙল দিয়ে ২০ সে.মি. দূরে দূরে সরু নালা তৈরি করতে হয় । ৪-৫ সে.মি. গভীর নালায় বীজ বপন করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয় । বপনের ১৫ দিন পর পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে ।
গম চাষে সার প্রয়োগ : গম চাষে সার প্রয়োগ দু’রকম হতে পারে । সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে মোট ইউরিয়া সারের তিন ভাগের দুই ভাগ এবং সবটুকু টিএসপি,এমওপি ও জিপসাম সার শেষ চাষের সময় দিতে হবে । বাকি এক ভাগ ইউরিয়া সার প্রথম সেচের সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে পুরো ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম সার শেষ চাষের সময় জমিতে দিতে হবে। গম চাষে সার প্রয়োগের পরিমাণ
| সারের নাম | সারের পরিমাণ / হেক্টর | সারের পরিমাণ / হেক্টর |
| সেচসহ | সেচছাড়া | |
| ইউরিয়া | ২০০ কেজি | ১৬০ কেজি |
| টিএসপি | ১৬০ কেজি | ১৬০ কেজি |
| এমওপি | ৪৫ কেজি | ৩৫ কেজি |
| জিপসাম | ১১৫ কেজি | ৮০ কেজি |
| গোবর/কম্পোস্ট সার | ৮.৫ টন | ৮.৫ টন |
গম চাষে পানি সেচ : মাটির বুনটের প্রকার অনুযায়ী গম চাষে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয় । প্রথম সেচ চারার তিন পাতার সময়, দ্বিতীয় সেচ গমের শিষ বের হওয়ার সময় এবং তৃতীয় সেচ দানা গঠনের সময় দিতে হবে ।
আগাছা দমন : সার, সেচের পানি ইত্যাদিতে আগাছা ভাগ বসায় । ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের আগে নিড়ানি দিতে হবে । উপরি প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে। গম ক্ষেত আগাছামুক্ত রাখার জন্য কমপক্ষে দুইবার নিড়ানি দিতে হবে ।
ফসল সংগ্রহ : গম পাকলে গাছ হলদে হয়ে মরে যায় । তালুতে শিষ নিয়ে ঘষলে দানা বের হয়ে আসবে । এ অবস্থায় গম কেটে ভালোভাবে শুকিয়ে মাড়াই যন্ত্র দিয়ে মাড়াই করতে হবে ।
বিনা চাষে গমের আবাদ
অনেক জমিতে রোপা আমন ধান কাটতে দেরি হয়। ফলে জমি চাষ-মই দিয়ে বীজ বোনার সময় থাকে না । এক্ষেত্রে বিনা চাষে গম আবাদ করা যায় । ধান কাটার পর যদি জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ হাঁটলে পায়ের দাগ পড়ে তবে সরাসরি বীজ বুনতে হয় । আবার জমিতে জো না থাকলে হালকা সেচ দিয়ে জো এলে বীজ বুনতে হয় । প্রথমে গম বীজ গোবর গোলানো পানিতে কয়েক ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে । পরে পানি থেকে উঠিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এতে বীজের গায়ে গোবরের প্রলেপ লেগে যায় । এ বীজ বপন করলে পাখির উপদ্রব কম হয় এবং বীজ রোদে শুকিয়ে যায় না ।
মহাসাগর কয়টি ও কি কি ? মহাসাগরের সকল তথ্য
স্বল্প চাষে গমের আবাদ
দেশি লাঙল দিয়ে দুইটি চাষ দিয়ে গম বীজ বপন করা যায়। ধান কাটার পর জমিতে জো আসার সাথে সাথে চাষ করতে হবে । আবার জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে সেচ দেয়ার পর জো আসলে চাষ দিতে হবে । প্রথমে একটি চাষ ও মই দিতে হবে । দ্বিতীয় চাষ দেওয়ার পর সব সার ও বীজ ছিটিয়ে দিয়ে মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে । বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে হালকাভাবে প্রথম সেচ দিতে হবে । প্রথম সেচের সময় ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে । বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে ।
গম চাষের সমস্যা
গম চাষে রোগ দমন
অন্যান্য শস্যের তুলনায় গম চাষের সমস্যা অপেক্ষাকৃত কম । গম চাষে পোকা মাকড়ের আক্রমণ তেমন একটা হয় না। তবে ছত্রাকজনিত বেশ কিছু রোগ দেখা দিতে পারে । এছাড়া অনেক সময় ইঁদুরের উপদ্রব দেখা যায়। ছত্রাকজনিত রোগের মধ্যে পাতার মরিচা রোগ, পাতার দাগ রোগ, গোড়া পচা রোগ, আলগা ঝুল রোগ এবং বীজের কালো দাগ রোগ অন্যতম ।
পাতার মরিচা রোগে প্রথমে পাতার উপর ছোট গোলাকার হলুদাভ দাগ পড়ে । শেষ পর্যায়ে এ রোগে মরিচার মতো বাদামি বা কালচে রঙে পরিণত হয় । হাত দিয়ে আক্রান্ত পাতা ঘষা দিলে লালচে মরিচার মতো গুড়া হাতে লাগে। এ রোগের লক্ষণ প্রথমে নিচের পাতায়, পরে সব পাতায় ও কাণ্ডে দেখা যায় । পাতার দাগ রোগে প্রথমে নিচের পাতায় ছোট ডিম্বাকার দাগ পড়ে। পরে দাগ আকারে বেড়ে পাতা ঝলসে যায়। এ রোগের জীবাণু বীজে বা ফসলের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে । গোড়া পচা রোগে মাটির সমতলে গাছের গোড়ায় হলদে দাগ দেখা যায়। পরে দাগ গাঢ় বাদামি বর্ণ ধারণ করে আক্রান্ত স্থানের চারপাশ ঘিরে ফেলে । পরে গাছ শুকিয়ে মারা যায় ।
গমের এসব ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাতের গম যেমন— কাঞ্চন, আকবর, অঘ্রাণী, প্রতিভা, সৌরভ, গৌরব চাষ করতে হবে । রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে । গম বীজ বপনের আগে শোধন করে নিতে হবে। সুষম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
ইঁদুর গমের একটি প্রধান শত্রু, গম চাষের সমস্যা । গমের শিষ আসার পর ইঁদুরের উপদ্রব শুরু হয় । গম পাকার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। ইঁদুর দমনের জন্য হাতে তৈরি বিষ টোপ বা বাজার থেকে কেনা বিষ টোপ ব্যবহার করা যায়। এসব বিষ টোপ সদ্য মাটি তোলা ইঁদুরের গর্তে বা চলাচলের রাস্তায় পেতে রাখতে হয় । বিষ টোপ ছাড়া বাঁশ বা কাঠের তৈরি ফাঁদের সাহায্যেও ইঁদুর দমন করা যায় ।
গমের শিষ বের হওয়ার সময় আলগা ঝুল রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় । আক্রান্ত গমের শিষ প্রথম দিকে পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে । পরে তা ফেটে যায় এবং দেখতে কালো ঝুলের মতো দেখায় । বীজের কালো দাগ রোগের ফলে গমের খোসায় বিভিন্ন আকারের বাদামি অথবা কালো দাগ পড়ে। বীজের ভ্রূণে দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে দাগ পুরো বীজে ছড়িয়ে পড়ে ।
এভাবে গম চাষ করলে দুইভাবে সার দেওয়া যায়- ১) বীজ বোনার সময় সব সার ছিটানো, ২) বীজ বপনের ১৭-২০ দিনের মধ্যে প্রথম হালকা সেচ দেওয়ার সময় সব সার ছিটানো। বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করা প্রয়োজন হয় ।
গম চাষ পদ্ধতি । সার প্রয়োগ ও অন্যান্য পরিচর্যা : পোস্টটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টবক্সে জানাতে পারেন ।



