নীলনদ আর পিরামিডের দেশ গল্প
নীলনদ আর পিরামিডের দেশ গল্প : সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প , অসাধারণ এক ভ্রমণ কাহিনী । গল্পের মাধ্যমে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন মিশরের অপরূপ দৃশ্য। আসুন আমরা নীলনদ আর পিরামিডের দেশ গল্প টি পড়ি –

নীলনদ আর পিরামিডের দেশ গল্প
সন্ধ্যের দিকে জাহাজ সুরেজ বন্দরে পৌঁছল।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ঘন নীলাকাশ কেমন যেন সূর্যের লাল আর নীল মিলে বেগুনি রং ধারণ করছে। ভূমধ্যসাগর থেকে একশ মাইল পেরিয়ে আসছে মন্দমধুর ঠান্ডা হাওয়া।
সূর্য অস্ত গেল মিশর মরুভূমির পিছনে। সোনালি বালিতে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সেটা আকাশের বুকে হানা দেয় এবং ক্ষণে ক্ষণে সেখানকার রং বদলাতে থাকে। তার একটা রং ঠিক চেনা কোন জিনিসের রং সেটা বুঝতে-না-বুঝতে সে রং বদলে গিয়ে অন্য জিনিসের রং ধরে ফেলে।
আমরা বন্দর ছেড়ে মরুভূমিতে ঢুকে গিয়েছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি, শহরের বিজলি বাতি ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে।
মরুভূমির উপর চন্দ্রালোক। সে এক অদ্ভূত দৃশ্য। সে দৃশ্য বাংলাদেশের সবুজ শ্যামলিমার মাঝখানে দেখা যায় না। সমস্ত ব্যাপারটা কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হয়। চলে যাচ্ছে দূর দিগন্তে, অথচ হঠাৎ যেন ঝাপসা আবছায়া পর্দায় ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়।
মাঝে মাঝে আবার হঠাৎ মোটরের দুমাথা উঁচুতে ওঠে। জ্বলজ্বল দুটি ছোট সবুজ আলো। ওগুলো কী? ভূতের চোখ নাকি? শুনেছি ভূতের চোখই সবুজ রঙের হয়। না! কাছে আসতে দেখি উটের ক্যারাভান-এদেশের ভাষাতে যাকে বলে ‘কাফেলা’।
উটের চোখের উপর মোটরের হেডলাইট পড়াতে চোখ দুটো সবুজ হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিয়েছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। আর কেনই পাব না বলো? মরুভূমি সম্বন্ধে কতো গল্প, কতো সত্য, কতো মিথ্যে পড়েছি ছেলেবেলায়। তৃষ্ণায় সেখানে বেদুইন মারা যায়, মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বেদুইন তার পুত্রের চেয়ে প্রিয়তর উটের গলা কাটে, উটের জমানো জল খায় প্রাণ বাঁচাবার জন্য ।
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের নিয়ম
যদি মোটর ভেঙে যায়? যদি কাল সন্ধ্যে অবধি এ রাস্তা দিয়ে আর কোনো মোটর না আসে? স্পষ্ট দেখতে পেলুম এ গাড়ি রওনা হওয়ার পূর্বে পাঁচশ গ্যালন জল সঙ্গে তুলে নেয় নি, তখন কী হবে উপায়? মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। জাহাজে চড়ার সময় কি কল্পনা করতে পেরেছিলুম, জাহাজে চড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোকটে মরুভূমির ভিতর দিয়ে চলে যাব?
কতোক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম মনে নেই। যখন মোটরের হঠাৎ একটুখানি জোর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল তখন দেখি চোখের সামনে সারি সারি আলো। কায়রো পৌঁছে গিয়েছি।
শহরতলিতে ঢুকলাম। খোলা জানালা দিয়ে সারি সারি আলো দেখা যাচ্ছে। এই শহরতলিতেই কতো না রেস্তোঁরা, কতো না ক্যাফে খোলা, খদ্দেরে খদ্দেরে গিসগিস করছে। রাত তখন এগারটা। আমি বিস্তর বড় বড় শহর দেখেছি। কায়রোর মতো নিশাচর শহর কোথাও চোখে পড়ে নি। কায়রোর রান্নার খুশবাইয়ে রাস্তা ম-ম করছে। মাঝে মাঝে নাকে এসে এমন ধাক্কা লাগায় যে মনে হয় নেমে পড়ে এখানেই চাট্টি খেয়ে যাই। অবশ্য রেস্তোরাগুলো আমাদের পাড়ার দোকানের মতো নোংরা । সবাই নিকটতম রেস্তোঁরায় হুড়মুড় করে ঢুকলুম। কারণ সবাই তখন ক্ষুধায় কাতর। তড়িঘড়ি তিনখানি ছোট ছোট টেবিল একজোড় করে চেয়ার সাজিয়ে আমাদের বসবার ব্যবস্থা করা হলো, রান্নাঘর থেকে স্বয়ং বাবুর্চি ছুটে এসে তোয়ালে কাঁধে বারবার ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাম জানালো।
মিশরীয় রান্না ভারতীয় রান্নার মামাতো বোন – অবশ্য ভারতীয় মোগলাই রান্নার। বারকোশে হরেক রকম খাবারের নমুনা। তাতে দেখলুম, রয়েছে মুরগি মুসল্লম, শিক কাবাব, শামি কাবাব আর গোটা পাঁচ-ছয় অজানা জিনিস। আমার প্রাণ অবশ্য তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছেভাজা, সোনামুগের ডাল, পটলভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য। অত-শত বলি কেন? শুধু ঝোল-ভাতের জন্য। কিন্তু ওসব জিনিস তো আর বাংলাদেশের বাইরে পাওয়া যায় না, কাজেই শোক করে কী লাভ ?
আনারস চাষ পদ্ধতি ও আনারসের উপকারিতা
আহারাদি সমাপ্ত করে আমরা ফের গাড়িতে উঠলুম। ততক্ষণে আমরা কায়রো শহরের ঠিক মাঝখানে ঢুকে গিয়েছি। গণ্ডায় গণ্ডায় রেস্তোঁরা, হোটেল, সিনেমা, ডানস্ হল, ক্যাবারে। খদ্দেরে তামাম শহরটা আবজাব করছে। কতো জাত-বেজাতের লোক।
ঐ দেখ, অতি খানদানি নিগ্রো। ভেড়ার লোমের মতো কোঁকড়া কালো চুল, লাল লাল পুরু দুখানা ঠোঁট, বোঁচা নাক, ঝিনুকের মতো দাঁত আর কালো চামড়ার কী অসীম সৌন্দর্য। আমি জানি এরা তেল মাখে না। কিন্তু আহা, ওদের সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন তেল ঝরছে।
ঐ দেখ, সুদানবাসী। সবাই প্রায় ছফুট লম্বা। আর লম্বা আলখাল্লা পরেছে বলে মনে হয়। দৈর্ঘ্য ছফুটের চেয়েও বেশি। এদের রং ব্রোঞ্জের মতো। এদের ঠোঁট নিগ্রোদের মতো পুরু নয়, টকটকে লালও নয়।
কায়রোতে বৃষ্টি হয় দৈবাৎ। তাও দু এক ইঞ্চির বেশি নয়। তাই লোকজন সব বসেছে হোটেল কাফের বারান্দায় কিংবা চাতালে। শুনলাম, এখানকার বায়স্কোপও বেশির ভাগ হয় খোলামেলাতে।
মোটর গাড়ি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে বলে ভালো করে সব কিছু দেখতে পেলুম না। কিন্তু এইবার চোখের সামনে ভেসে উঠল অতি রমণীয় এক দৃশ্য। নাইল—নীল নদ।
চাঁদের আলোতে দেখছি, নীলের উপর দিয়ে চলেছে মাঝারি ধরনের খোলা মহাজনি নৌকা-হাওয়াতে কাত হয়ে তেকোণা পাল পেটুক ছেলের মতো পেট ফুলিয়ে দিয়ে। ভয় হয়, আর সামান্য একটুখানি জোর হাওয়া বইলেই, হয় পালটা এক ঝটকায় চৌচির হয়ে যাবে, নয় নৌকাটা পিছনে ধাক্কা খেয়ে গোটা আড়াই ডিগবাজি খেয়ে নীলের অতলে তলিয়ে যাবে।
এই নীলের জল দিয়ে এদেশের চাষ হয়। এই নীল তার বুকে ধরে সে চাষের ফসল মিশরের সর্বত্র পৌঁছে দেয় । পিরামিড! পিরামিড!! পিরামিড ! ! !
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনটে পিরামিড? এই তিনটে পিরামিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো কীর্তিস্তম্ভ । যুগ যুগ ধরে মানুষ এদের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা করেছে, দেয়ালে খোদাই এদের লিপি উদ্ধার করে এদের সম্বন্ধে পাকা খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে।
মিশরের ভিতরে-বাইরে আরও পিরামিড আছে। কিন্তু গিজে অঞ্চলের যে তিনটি পিরামিডের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে, সেগুলোই ভুবনবিখ্যাত, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম।
প্রায় পাঁচশ ফুট উঁচু বলে, না দেখে চট করে পিরামিডের উচ্চতা সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায় না। এমন কি চোখের সামনে দেখেও ধারণা করা যায় না, এরা ঠিক কতোখানি উঁচু। চ্যাপ্টা আকারের একটা বিরাট জিনিস আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে পাঁচশ ফুট উঁচু না হয়ে যদি চোঙ্গার মতো একই সাইজ রেখে উঁচু হতো, তবে স্পষ্ট বোঝা যেত পাঁচশ ফুটের উচ্চতা কতোখানি উঁচু।
বোঝা যায়, দূরে চলে গেলে। গিজে এবং কায়রো ছেড়ে বহুদূরে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ চোখে পড়ে তিনটি পিরামিড—সব কিছু ছাড়িয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
তাই বোঝা যায়, এ বস্তু তৈরি করতে কেন তেইশ লক্ষ টুকরো পাথরের প্রয়োজন হয়েছিল। ‘টুকরো’ বলতে একটু কমিয়ে বলা হলো, কারণ এর চার-পাঁচ টুকরো একত্রে করলে একখানা ছোট-খাট ইঞ্জিনের সাইজ এবং ওজন হয়। কিংবা বলতে পার, ছ ফুট উঁচু এবং তিন ফুট চওড়া করে এ পাথর দিয়ে একটা দেয়াল বানালে সে দেয়াল লম্বায় ছশ পঞ্চাশ মাইল হবে।
সবচেয়ে বড় পিরামিডটা বানাতে নাকি এক লক্ষ লোকের বিশ বৎসর লেগেছিল। ফারাওরা (সম্রাটরা) বিশ্বাস করতেন, তাদের শরীর যদি মৃত্যুর পর পচে যায় কিংবা কোনো প্রকারের আঘাতে ক্ষত হয়, তবে তাঁরা পরলোকে অনন্ত জীবন পাবেন না। তাই মৃত্যুর পর দেহকে ‘মমি’ বানিয়ে সেটাকে এমন একটা শক্ত পিরামিডের ভিতর রাখা হতো যে, তার ভিতর ঢুকে কেউ যেন মমিকে ছুঁতে পর্যন্ত না পারে।
নিদ্রিতের চোখে যে রকম পড়ে, আমার চোখে ঠিক তেমনি এসে পড়লো পশ্চিমাকাশ থেকে চন্দ্রাস্তের রক্তচ্ছটা আর পূর্বাকাশ থেকে নব অরুণোদয়ের পূর্বাভাস।
রাস্তা ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। রাস্তায় দুদিকে দোকানপাট এখনও বন্ধ। দু একটা কফির দোকান খুলি খুলি করছে। ফুটপাতে লোহার চেয়ারের উপর পদ্মাসনে বসে দু-চারটি সুদানি দারোয়ান তসবি জপছে, খবরের কাগজগুলোর দোকানের সামনে অল্প একটু ভিড়।
তরল অন্ধকার সরল আলোর জন্য ক্রমেই জায়গা করে দিচ্ছে। আধো ঘুমে আধো জাগরণে জড়ানো হয়ে সব কিছুই যেন কিছু কিছু দেখা হলো। সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল মসজিদের মিনারগুলোকে। এদের বহু মিনার দাঁড়িয়ে আছে আল্লাহর নামাজের ঘর মসজিদের উপর। মসজিদে যে নিপুণ মোলায়েম কারুকার্য আছে সে রকম করবার মতো হাত আজকের দিনে কারও নেই ।
প্রকৃতির গড়া নীল, আর মানুষের গড়া পিরামিডের পরেই মিশরের মসজিদ ভুবন বিখ্যাত এবং সৌন্দর্যে অতুলনীয়। পৃথিবীর বহু সমঝদার শুধু এই মসজিদগুলোকেই প্রাণভরে দেখবার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে কায়রোতে আসেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী র ভ্রমণ কাহিনী মূলক গল্প নীলনদ আর পিরামিডের দেশ গল্পটি সম্পর্কে আপনাদের মূল্যবান মতামত কমেন্টবক্সে জানাতে পারেন । ধন্যবাদ ।



